
আর শেরু ওই মেঝেতে কিছুক্ষণ ওইভাবেই পড়ে রইল। ভাবল, মালকিনদের মধ্যে কেউ তো একজন এসে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ঝাঁপিতে রাখবে। আমি আর কষ্ট করে নড়ব কেন। সেখানে গিয়ে শান্তিতে আমার টেডি বেয়ারটা জড়িয়ে ধরে ঘুমাব।
এইখানে দুটো কথা জানিয়ে দিই। এক, নাগিন কন্যাই ওর আসল মালকিন। আমি আইনত ওর মালকিন নই। তবু, মায়া পড়ে গেছে জানেন তো! আমিও মাঝে মধ্যে ওর পিঠ চুলকে দিই। দুপুর বেলা ভাঙা-বাজার থেকে চুনো মাছ এনে খেতে দিই।
আর দুই, শেরুর একটা টেডি বেয়ার আছে। ইঞ্চি চারেক সাইজ। ফ্যাকাশে কমলা রং। নরম ফারের গা। ওটাকে পেঁচিয়েই শেরু ঘুমায়। ওটি তার ফেভারিট ও একমাত্র খেলনা।
মিনিট পনেরো কুড়ি বা তারও বেশি কেটে যাওয়ার পরেও শেরু দেখল কেউ তাকে ঝাঁপিতে তুলে রাখতে এল না। এমন নয় যে সে নিজে নিজে চলে যেতে পারবে না। দিব্যি হেঁটে চলে বেড়াতেই পারে। কিন্তু ওই যে, অলস! শেরু ওই মেঝেতেই পড়ে পড়ে ঝিমুতে শুরু করল।
কতক্ষণ কেটেছে জানি না। আমি কীভাবে জানব বলুন, অকুস্থলে তো আমি নেই-ই। নেহাত গল্পটা লিখতে বসেছি বলে, ঈশ্বরের দৃষ্টি দিয়ে দেখছি। একেই ঠান্ডা মেঝে, তার উপর টেডির অনুপস্থিতি; শেরুর ঘুম গেল চটকে। বেচারার খিদেও কম পায়নি। সেই কোন দুপুরবেলা চাট্টি মুরগির ছালের টুকরো খেয়েছে। খিদের জ্বালায় শেরুর ঝিমুনি কেটে গেল।
মুখ তুলেই সে দেখতে পায় দরজা খোলা। আমাদের ঘরে চট করে আমরা দরজা খুলে রাখি না। ঘরে থাকিও কম। যখনই যাই, তালা মেরেই বের হই। চাবি দুজনের কাছেই আছে। আর দরজা খুলে ঘরকন্না করা, আমাদের শোভা পায় না। কেউ কেউ থাকে, দরজা হাট করে খোলা, তার সামনেই উবু হয়ে বসে উকুন বাছছে, আটা মাখছে, আবার ভাড়াটেদের নামে কেচ্ছাও গাইছে চিৎকার করে। আমাদের সে সবের ঝামেলা নেই।
শেরু যতই না-মানুষ হোক, ছুঁচোবাজি স্বভাবটা মনে হয় এই পৃথিবীর সব জীবের মধ্যেই থাকে। তায় শেরু তো বাইবেলের শয়তানের বংশধর! ওই পড়ন্ত বিকেল। তায় নিভু নিভু আলো। তার মধ্যে হয়তো অ্যাডভেঞ্চারের নেশা চেগে উঠল। তাই ঘরের মধ্যে পড়ে থাকা নিজের ঝাঁপিটার মধ্যে না সেঁধিয়ে, সে আমাদের ঘরের চৌকাঠ টপকাল। একা, এবং জীবনে এই প্রথমবার।
সীতার মনে আছে তো কী হয়েছিল? ভারতবর্ষের আবালবৃদ্ধবনিতা জানে, ভিকিরিকে ‘এই যাই বাপ’ বলে এক কথাতেই ভিক্ষা দিতে যেতে নেই। নাম, গোত্র, আধার কার্ডের নম্বর জানালে তাও একটু দাক্ষিণ্য দেখানো যেতে পারে। কিন্তু শেরুকে কেউ রামায়ণ শোনায়নি। শোনানোর কথা আমাদের মাথাতেও আসেনি। তাই শেরু জানে না লক্ষণরেক্ষা কক্ষনোও ক্রস করতে নেই। সে বেচারা গজেন্দ্রগমনে—মানে একটা বুড়ো দামরা সাপের চলন আর কীভাবে বোঝাব বলুন—আমাদের ভাড়াবাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল।
রাজনীতির সাথে অপরাধ জগতের সম্পর্ক খুব একটা নতুন কিছু নয়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং তার সাথে অপরাধ জগতের সম্পর্ক দেখলে মনে হয় কোন সিরিও-কমিক ডিস্টপিয়া তে আছি। এরকমই এক সিরিও কমিক ডিস্টপিয়া অথবা ইউটোপিয়া ( ওই জিনিসটা যার যার দৃষ্টিভঙ্গির উপর ডিপেন্ড করে) নিয়ে আসছে স্মেল অফ বুকস, Suparna Chatterjee Ghoshal র কলমে।
সামান্য একটা ডোর হ্যাঙ্গার চুরি করতে গিয়ে এমন ছুঁচোবাজি টাইপের কেস খেয়ে যাবে, পলি মনে হয় তা জীবনেও কল্পনা করেনি। আর সে একাই ওই কেলোর কীর্তিতে ফাঁসল না, সঙ্গে ডুবল নাগিন কন্যাও।
ঘটনাক্রমে এই কদিনের মধ্যে তাদের জীবনে ঝড়ের মতো এসে হাজির হল সর্দার উর্ফ খলনায়ক টু পয়েন্ট ও, বেদেবুড়ো থেকে শুরু করে ভানু লাহিড়ী হয়ে হাসানগঞ্জের পুলিশ, মায় সতু দস্তিদার অবধি।
মার-মার কাট-কাট চেজিং সিন, বিচিত্রতর চরিত্র আর ধুমধাড়াক্কা ঘটনায় ভরা এই বই হাতে তুলে নিলে পাক্কা পাল্প ফিকশনের স্বাদ পাবেন। এই গোলমেলে নাগরদোলায় একবার চাপলে আর কিন্তু রেহাই নেই।
অতএব, সাধু, ভেরি ভেরি সাবধান!
প্রচ্ছদ : Ratnadip Chatterjee এবং Tathagata Chaudhuri
Comments